Breaking
24 Sep 2025, Wed

ত্রিপুরার আদিবাসী জনগোষ্ঠী: ইতিহাস, উৎস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক রাজ্য, যার প্রাচীন ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বহুত্ব আজও সমানভাবে আলোচিত। এই রাজ্যের মূল অধিবাসীদের মধ্যে অন্যতম হলো ত্রিপুরী জনগোষ্ঠী বা স্থানীয় ভাষায় তিপ্রা। তারা তিব্বত-বর্মন ভাষী জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। কিন্তু তাদের উৎস, বসতি স্থাপন এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানকে ঘিরে নানা ধরনের বিতর্ক ও আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

এই প্রবন্ধে আমরা ত্রিপুরার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উৎস, আগমনপথ, ইতিহাস, রাজ্য পরিচালনায় তাদের ভূমিকা এবং সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করব। একই সঙ্গে এই প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশি’ তকমা দেওয়ার যে রাজনীতি, তার ভেতরের অসংগতি এবং কৌতুকজনক দিকও তুলে ধরা হবে।


ত্রিপুরার আদিবাসীদের উৎস ও ভাষাগত পরিচয়

ত্রিপুরার মূল আদিবাসী জনগোষ্ঠী—ত্রিপুরী বা তিপ্রারা—তিব্বত-বর্মন ভাষা পরিবারভুক্ত। ইতিহাসবিদ ও নৃতত্ত্ববিদদের মতে, এরা মূলত তিব্বত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অভিবাসিত হয়ে এসেছে। খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে তারা দক্ষিণমুখী অভিবাসনের পথে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করে।

ত্রিপুরা রাজ্যে এসে তারা ধীরে ধীরে নিজেদের স্বাধীন রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলে। একসময়ে তারা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে, যা কয়েক শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলের শাসনকার্য চালায়।

ত্রিপুরার রাজারা নিজেদের মনিপুরী, আরাকান, এমনকি বার্মিজ রাজাদের সঙ্গেও বিয়োগসূত্র ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। ফলে তাদের সংস্কৃতিতে ভারতীয়, আরাকানি, ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় প্রভাব একসঙ্গে মিশে গেছে।


বসতি স্থাপনের ইতিহাস

ত্রিপুরী জনগোষ্ঠী কেবল বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটের কিছু অংশ এবং মিয়ানমারের সীমানা অঞ্চলেও বসবাস করে আসছে। অর্থাৎ তাদের বসতি একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।

আজও ত্রিপুরার বাইরে, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এলাকায় প্রচুর ত্রিপুরী জনগোষ্ঠী বসবাস করে। আবার ভারতের আসাম, মিজোরাম, এমনকি ভুটান ও মিয়ানমারের কিছু অংশেও তাদের দেখা মেলে।

Also Read  ত্রিপুরায় বাঙালিদের বসবাস: ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট

এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, এই জনগোষ্ঠীর উৎপত্তি ও বিস্তার বহুমুখী। রাষ্ট্রসীমা পরবর্তীকালে কেটে দেওয়া হলেও, তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা ভেঙে যায়নি।


ত্রিপুরার রাজবংশ ও ত্রিপুরীদের ভূমিকা

ত্রিপুরা রাজ্যের শাসনভার বহু শতাব্দী ধরে ত্রিপুরী রাজবংশের হাতেই ছিল। ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, ত্রিপুরার মানিক্য রাজবংশ প্রায় ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে টিকে ছিল। তাদের রাজধানী প্রথমে উদয়পুর, পরে আগরতলা।

ত্রিপুরার রাজারা কখনও দিল্লি সুলতানাত, কখনও মুঘলদের করদ রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও বাস্তবে তারা নিজেদের স্বাধীন শাসন বজায় রেখেছিল। এই রাজবংশের সর্বশেষ স্বাধীনতা বিলীন হয় ১৯৪৯ সালে, যখন ত্রিপুরা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়।

অতএব, ত্রিপুরার ইতিহাসে ত্রিপুরী জনগোষ্ঠীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে অপরিসীম।


ত্রিপুরার জনসংখ্যার পরিবর্তন

ঐতিহাসিকভাবে ত্রিপুরা ছিল আদিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ শতক জুড়ে ক্রমে বাঙালিদের আগমন ও বসতি স্থাপন শুরু হয়।

  • প্রথমত, ব্রিটিশ শাসনামলে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কারণে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু বাঙালি ত্রিপুরায় এসে বসবাস শুরু করেন।
  • দ্বিতীয়ত, দেশভাগ (১৯৪৭) এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৯৭১) চলাকালীন বিপুল সংখ্যক বাঙালি উদ্বাস্তু ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়।

ফলে বর্তমানে ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার সিংহভাগই বাঙালি। আদিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে।


“বাংলাদেশি” বিতর্ক: কে কার?

বর্তমান রাজনৈতিক পরিসরে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিছু ত্রিপুরী রাজনৈতিক নেতা ও সংগঠন বাঙালিদের “বাংলাদেশি” বলে সম্বোধন করে। তাদের দাবি, বাঙালিরা বহিরাগত।

কিন্তু এখানে একটি বড়ো ধরনের সাংঘর্ষিক বাস্তবতা রয়েছে।

  1. ত্রিপুরীরা নিজেরাই এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা নয়। তারা তিব্বত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে এসেছে। অর্থাৎ তারাও অভিবাসী।
  2. আজও ত্রিপুরী জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি মানুষ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করছে।
  3. তাহলে প্রশ্ন জাগে, যারা নিজেরাই সীমান্ত পারাপার হয়ে এসেছে, তারা কীভাবে অন্যদের ‘বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করে?
Also Read  ত্রিপুরা রাজ্যের বাঙালি প্রজাদের অবদান ও উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মাণ ব্যয়ের প্রকৃত ইতিহাস

এখানেই বিষয়টি হাস্যকর হয়ে ওঠে।


“ভারতবর্ষ” ও “বাংলাদেশ” প্রসঙ্গ

ত্রিপুরার কিছু গোষ্ঠী যখন বাঙালিদের বাংলাদেশি বলে তকমা দেয়, তখন তারা ভুলে যায় একটি মৌলিক সত্য।

  • প্রথমত, বাংলাদেশ একসময় ভারতেরই অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে ভারত ও বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র ছিল না।
  • দ্বিতীয়ত, মানুষের চলাচল, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের আদানপ্রদান তখন ছিল স্বাভাবিক। ফলে একজন বাঙালি যদি ত্রিপুরায় এসে বসবাস করত, তাকে বহিরাগত বলা যেত না।

বর্তমান রাজনীতিতে সীমান্তের লাঠিখেলা ব্যবহার করে মানুষের পরিচয় নির্ধারণ করা হলেও ইতিহাস মোটেই তা সমর্থন করে না।


রাজতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র

ত্রিপুরার ইতিহাসে দীর্ঘকাল রাজতন্ত্র ছিল। কিন্তু ১৯৪৯ সালে ভারতভুক্তির পর থেকে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। বর্তমানে এই রাজ্য ভারতীয় সংবিধানের অধীনে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

এখানে নাগরিকত্ব নির্ধারণের বিষয়টি আইনি ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় নির্ভরশীল। তাই কাকে ‘এ রাজ্যের লোক’ বলা হবে, তা আর কোনো উপজাতি বা সম্প্রদায়ের একচেটিয়া সিদ্ধান্ত নয়।

আজকের দিনে ত্রিপুরা রাজ্যে জন্ম নেওয়া বা বৈধভাবে বসবাসকারী বাঙালিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলাই অযৌক্তিক।


সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়

ত্রিপুরার সংস্কৃতিতে আজ ত্রিপুরী ও বাঙালি সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে।

  • ত্রিপুরী উৎসব যেমন খারচি পূজা, গরিয়া পূজা আজও সমানভাবে উদযাপিত হয়।
  • অন্যদিকে, দুর্গাপূজা এখন ত্রিপুরার সবচেয়ে বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
  • ভাষার ক্ষেত্রেও ত্রিপুরী ও বাংলা ভাষার মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব লক্ষ করা যায়।

অতএব, বহুত্ববাদই এই রাজ্যের প্রকৃত শক্তি।


উপসংহার

ত্রিপুরার আদিবাসী জনগোষ্ঠী—বিশেষ করে ত্রিপুরী বা তিপ্রারা—ঐতিহাসিকভাবে বহিরাগত উৎস থেকে এসেও এই রাজ্যের রাজবংশ গড়ে তুলেছিল। আবার বাঙালিরাও বহু শতাব্দী ধরে এখানে বসবাস করে নিজেদের অবস্থান স্থায়ী করেছে।

আজ যদি তিপ্রারা বাঙালিদের ‘বাংলাদেশি’ বলে অভিযুক্ত করে, তবে তারা ভুলে যায়—

  1. তারাও নিজেরাই বহিরাগত উৎস থেকে এসেছে।
  2. তাদের একটি বড় অংশ আজও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে বসবাস করছে।
  3. আর সবচেয়ে বড় কথা—এখন রাজতন্ত্র নেই, আছে গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় জন্মসূত্রে ও বসবাসের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয়, উপজাতি পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়।
Also Read  ত্রিপুরায় বাঙালি জাতির বসবাসের ইতিহাস

Share this content:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *