ত্রিপুরা রাজ্যের আদিবাসী একমাত্র বাঙালিরাই এবং এই রাজ্যের আদি নাম শ্রীভূমি

এই ত্রিপুরা রাজ্যের আদিবাসী একমাত্র বাঙালিরাই এবং এই রাজ্যের আদি নাম শ্রীভূমি

(ঐতিহাসিক দলিল, মুদ্রা ও পুঁথির আলোকে বিশ্লেষণ)

ভূমিকা

ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। ভৌগোলিক দিক থেকে ছোট হলেও ইতিহাস ও সংস্কৃতির দিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ রাজ্যে নানা জাতিগোষ্ঠীর আগমন ঘটেছে, ফলে এর সাংস্কৃতিক কাঠামো বহুবর্ণিল। তবে ইতিহাসের গভীরে গেলে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়—ত্রিপুরার প্রকৃত আদিবাসী কারা?

প্রচলিত ধারা অনুযায়ী অনেকেই মনে করেন যে ত্রিপুরার আদিবাসী মূলতমাননীয় মণিক সাহা এইবার দুর্গাপূজার পূর্বে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন বিভিন্ন ত্রিপুরী বা উপজাতি সম্প্রদায়। কিন্তু বহু প্রাচীন দলিল, শিলালিপি, মুদ্রা, তাম্রলিপি, রাজদরবারের নথি, মন্ত্রিপরিষদের দলিল এবং পুঁথিপত্রের প্রমাণ ঘেঁটে দেখা যায়—ত্রিপুরার প্রাচীনতম অধিবাসী, তথা এই ভূমির আদিবাসী ছিলেন বাঙালিরাই। এবং এই রাজ্যের আদি নামও ছিল “শ্রীভূমি”, যা বাংলাভাষার সংস্কৃতনির্ভর রূপ।

এই প্রবন্ধে আমরা সেই ঐতিহাসিক প্রমাণসমূহ আলোচনার মাধ্যমে দেখব কীভাবে বাঙালিরাই ত্রিপুরার প্রাচীন অধিবাসী হিসেবে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছেন।


আদি নাম শ্রীভূমি: ঐতিহাসিক প্রমাণ

ত্রিপুরার নামকরণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা হয়েছে। আজকের “ত্রিপুরা” নামের প্রচলন মূলত মিথ ও কিংবদন্তির সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু প্রাচীন দলিলপত্র ঘাঁটলে দেখা যায়, এই ভূমিকে একসময় শ্রীভূমি নামে ডাকা হতো।

  • “শ্রীভূমি” শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে। “শ্রী” অর্থ সমৃদ্ধি, দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক, আর “ভূমি” অর্থ ভূমি বা দেশ। অর্থাৎ শ্রীভূমি মানে সমৃদ্ধির ভূমি।
  • মধ্যযুগীয় বহু রাজদরবারের দলিলে শ্রীভূমি নামের উল্লেখ রয়েছে। এমনকি বহু প্রাচীন মুদ্রায়ও এই নাম খোদাই করা হয়েছে।
  • প্রখ্যাত ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন যে, মোগল যুগ এবং পরে মণিক্য রাজাদের সময়ে শ্রীভূমি নাম ব্যবহৃত হতো আনুষ্ঠানিকভাবে।

এর ফলে বোঝা যায়, ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাচীন ও স্বীকৃত নাম ছিল শ্রীভূমি, যা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে স্পষ্টতই বাংলার সঙ্গে যুক্ত।


মুদ্রা ও তাম্রশাসনের দলিল

ত্রিপুরা রাজ্যে যত পুরোনো মুদ্রা ও শাসনসংক্রান্ত দলিল পাওয়া গেছে, সবই বাংলাভাষায় বা সংস্কৃত-বাংলা মিলিয়ে লেখা। এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে আলোচনা করা হলো—

  1. মণিক্য রাজাদের মুদ্রা:
    মণিক্য বংশের রাজারা (১৪তম শতাব্দী থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত) তাঁদের মুদ্রায় বাংলার লিপি ব্যবহার করতেন। “শ্রীশ্রী গণেশ”, “শ্রীশ্রী দুর্গা” ইত্যাদি নাম বাংলায় উৎকীর্ণ ছিল।
  2. রাজকীয় তাম্রলিপি ও দস্তাবেজ:
    ভূমি দান, মন্দির নির্মাণ, সীমানা নির্ধারণ, আইন সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র—সবকিছু বাংলায় লেখা হয়েছে। যদি উপজাতি ভাষা এই ভূমির প্রাচীনতম হতো, তবে এসব নথি সেই ভাষায় লেখা থাকার কথা। কিন্তু কোথাও উপজাতীয় ভাষার ব্যবহার দেখা যায় না।
  3. রাজদরবারের পুঁথি:
    ত্রিপুরার রাজদরবারে সংরক্ষিত পুঁথিগুলি (যেমন: রাজমালা) সব বাংলায় লেখা। রাজমালা কাব্য, যা ত্রিপুরার ইতিহাসের অন্যতম নির্ভরযোগ্য দলিল, সম্পূর্ণ বাংলায় রচিত।

দলিল-দস্তাবেজ ও পুঁথি-নথি

ত্রিপুরার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় যে, প্রশাসন, রাজনীতি, ধর্মীয় অনুশাসন ও সাহিত্য—সব ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষা ছিল প্রভাবশালী।

  • রাজমালা: ১৫শ শতকে শুরু হওয়া এই ঐতিহাসিক কাব্যগ্রন্থটি বাংলায় লেখা, যা ত্রিপুরার রাজাদের বংশপরম্পরা বর্ণনা করে।
  • আদালত ও কর ব্যবস্থা: কর আদায় সংক্রান্ত যে দলিলপত্র পাওয়া যায়, সবই বাংলায়।
  • মন্দিরের শিলালিপি: মন্দিরে দেবদেবীর উদ্দেশ্যে উৎকীর্ণ শিলালিপি বাংলায় খোদাই করা ছিল।

এটি প্রমাণ করে যে ত্রিপুরার সমাজ-রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশে বাংলা ভাষাই ছিল মূল মাধ্যম।


বাঙালিরাই কেন আদিবাসী?

এখন প্রশ্ন আসে—ত্রিপুরার একমাত্র আদিবাসী কেন বাঙালিরাই?

  1. ভাষাগত প্রমাণ:
    প্রাচীনতম দলিল, মুদ্রা, শিলালিপি—সব বাংলায়। যদি বাঙালিরা বহিরাগত হতেন, তবে তাঁদের ভাষা কীভাবে প্রাচীনতম প্রশাসনিক ভাষা হয়ে ওঠে?
  2. ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগ:
    ত্রিপুরা ভৌগোলিকভাবে বরাবরই বঙ্গদেশের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী প্রভৃতি অঞ্চল একসময় ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে ত্রিপুরা ও বাংলা এক অবিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক পরিসরের মধ্যে পড়ে।
  3. রাজশক্তির ধারাবাহিকতা:
    মণিক্য রাজবংশ বাংলাভাষী পরিবেশে গড়ে ওঠে এবং বাংলা ভাষাকেই প্রশাসন ও সাহিত্যের মাধ্যম বানায়। এটি প্রমাণ করে বাঙালিরাই ছিল এ ভূমির প্রাচীন জনগোষ্ঠী।
  4. উপজাতি সম্প্রদায়ের আগমন:
    ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায় ধাপে ধাপে পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে ত্রিপুরায় প্রবেশ করে। তাঁরা তুলনামূলকভাবে পরবর্তীকালে এসেছেন। ফলে তাঁদেরকে “আদিবাসী” বলা ইতিহাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বাংলার সাংস্কৃতিক ছাপ

ত্রিপুরার সংস্কৃতিতে বাঙালির প্রভাব এতটাই গভীর যে আজও তা স্পষ্ট।

  • ভাষা: বর্তমানে ত্রিপুরার সরকারি ভাষা বাংলা। শিক্ষাব্যবস্থা, সাহিত্য, সংবাদপত্র, আদালত—সবকিছুতেই বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়।
  • সাহিত্য ও সংগীত: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা সাহিত্য—সবই ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক ভাণ্ডারে স্থান পেয়েছে।
  • ধর্মীয় উৎসব: দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা প্রভৃতি উৎসব প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত।
  • লোকসংস্কৃতি: গান, নৃত্য, কবিতা, পুঁথিপাঠ—সব বাংলার ধারাতেই গড়ে উঠেছে।

Indigenous

“শ্রীভূমি”—এই আদি নামটিই প্রমাণ করে ত্রিপুরার প্রাচীনতম পরিচয় বাংলার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। ফলে ত্রিপুরাকে যদি তার প্রকৃত ঐতিহাসিক আলোকে দেখা হয়, তবে বলা যায়—ত্রিপুরা রাজ্যের আদিবাসী একমাত্র বাঙালিরাই, আর এই ভূমি প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীভূমি নামে পরিচিত ছিল।

 

Share this content:

ত্রিপুরা রাজ্যের আদিবাসী একমাত্র বাঙালিরাই এবং এই রাজ্যের আদি নাম শ্রীভূমি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to top