ত্রিপুরা রাজ্যের বাঙালি প্রজাদের অবদান ও উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মাণ ব্যয়ের প্রকৃত ইতিহাস

ত্রিপুরা রাজ্যের বাঙালি প্রজাদের অবদান ও উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মাণ ব্যয়ের প্রকৃত ইতিহাস

ত্রিপুরা রাজ্যের একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে সম্প্রতি এমন কিছু কথাবার্তা বলে চলেছে, যেন এই রাজ্যের বাঙালি জনগোষ্ঠীর লোকেরা এই রাজ্যের রাজাদের প্রজাই ছিল না! অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ত্রিপুরার মহারাজারা তাঁদের রাজত্ব পরিচালনা, প্রশাসন বজায় রাখা, সেনাদল রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রাসাদোপম স্থাপত্য নির্মাণ— সবক্ষেত্রেই সমতল অঞ্চলের প্রজাদের শ্রম ও ঘামে অর্জিত অর্থের উপর নির্ভর করতেন। বিশেষত, কুমিল্লা-নোয়াখালী এলাকার বিস্তৃত সমতলভূমি “চাকলা রোশনাবাদ”-এর কৃষিজমি থেকে সংগৃহীত রাজস্বই ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের আর্থিক ভিত্তি।

রাজনৈতিক বক্তৃতায় অনেকে নানা ধরনের দাবি তুলতে পারেন; কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, রাজপরিবারের ঐশ্বর্য, প্রশাসনিক সক্ষমতা, এবং মহিমান্বিত উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের মতো স্থাপত্য— সবকিছুর পেছনেই রয়েছে সমতল ত্রিপুরার বাঙালি কৃষিজীবী প্রজাদের ঘাম ও রক্তে অর্জিত সম্পদ।


উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ: ইতিহাসের সাক্ষী

ত্রিপুরা রাজ্যের প্রধান স্থাপত্য নিদর্শন উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ। বর্তমানে এটি শুধু আগরতলার একটি ঐতিহাসিক দালান নয়, বরং সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থাপত্য ঐতিহ্যের একটি অনন্য নিদর্শন।

  • নির্মাণকাল: ১৮৯৯–১৯০১ খ্রিস্টাব্দ
  • নির্মাতা: মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্য বাহাদুর
  • স্থপতি প্রতিষ্ঠান: Martin & Burn Co. (কলকাতা)
  • নির্মাণ ব্যয়: প্রায় ১০ লক্ষ টাকা (সেই সময়ের জন্য এক বিশাল অঙ্ক)

এই বিপুল ব্যয়ের উৎস কোথা থেকে এল? ইতিহাস ঘাঁটলে স্পষ্ট দেখা যায়, চাকলা রোশনাবাদের উর্বর কৃষিজমি থেকেই সংগৃহীত রাজস্বই ছিল উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মাণ খরচের প্রধান ভিত্তি।


চাকলা রোশনাবাদ: ত্রিপুরার অর্থনৈতিক ভিত্তি

জমিদারি অধিকার

মুঘল আমলে ১৭৩৩ সাল থেকে ত্রিপুরার মহারাজারা “চাকলা রোশনাবাদ” অঞ্চলের জমিদারির অধিকার লাভ করেন। এই অঞ্চলটি বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং আংশিক চাঁদপুর ও ফেনী জেলার বিস্তীর্ণ সমতলভূমি জুড়ে বিস্তৃত ছিল।

কৃষিজ উৎপাদন ও রাজস্ব

চাকলা রোশনাবাদ অঞ্চলের মাটি ছিল অতি উর্বর। ধান, আখ, পাটসহ নানা ফসল উৎপাদন হতো এখানে। কৃষিজ surplus এর উপর ভিত্তি করেই রাজস্ব আদায় সম্ভব হতো। এই রাজস্ব সরাসরি পৌঁছে যেত ত্রিপুরা রাজ্যের কোষাগারে।

রাজস্বের ব্যবহার

  • রাজপ্রাসাদ ও দুর্গ নির্মাণ
  • রাজপরিবারের ভোগ-বিলাস
  • সেনাদল রক্ষণাবেক্ষণ
  • রাজোৎসব ও পূজা-পার্বণ
  • প্রশাসনিক ব্যয়

অর্থাৎ, চাকলা রোশনাবাদ ছাড়া ত্রিপুরার রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে যেত।


পার্বত্য ত্রিপুরার অবদান কতটুকু?

ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চলের জনজাতীয় সমাজ মূলত জুমচাষের উপর নির্ভরশীল ছিল। জুমচাষে উৎপাদন সীমিত, উদ্বৃত্ত ফসল প্রায় ছিল না। ফলে নিয়মিত রাজস্ব আদায় করা এখানে কার্যত অসম্ভব ছিল।

  • পাহাড়ি অঞ্চল থেকে রাজস্ব আয় ছিল নগণ্য।
  • অনেক সময় কর আরোপের ফলে উপজাতি সমাজে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। যেমন— রিয়াং বিদ্রোহকুকি বিদ্রোহ। এগুলো রাজশক্তি দ্বারা দমন করা হয়েছিল।
  • অর্থাৎ, পাহাড়ি অঞ্চল কখনোই বৃহৎ রাজকীয় ব্যয়ের উৎস হতে পারেনি।

রাজন্য ত্রিপুরার ঐশ্বর্য: সমতল প্রজাদের ঘামে গড়া

উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ হোক বা আগরতলার বিভিন্ন রাজপ্রাসাদ, রাজকীয় উৎসব হোক বা প্রশাসনিক ব্যয়— সব ক্ষেত্রেই চাকলা রোশনাবাদ ও সমতল প্রজাদের ঘাম ঝরানো টাকাই মূল শক্তি ছিল।

  • উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের প্রতিটি ইট, প্রতিটি বালুকণা যেন সাক্ষ্য দেয় সমতল কৃষকের অবদানের।
  • পাহাড়ি সমাজও ত্রিপুরার অংশ, কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য রাজকোষ ভরাতে সক্ষম ছিল না।

ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা

আজকের দিনে যদি কেউ দাবি করেন যে, বাঙালি জনগোষ্ঠী এই রাজ্যের “বহিরাগত” বা “ভাড়াটিয়া”, তবে সেটা হবে ইতিহাস বিকৃতি।

  • ত্রিপুরার মহারাজাদের রাজত্ব টিকে ছিল মূলত সমতল বাঙালি প্রজাদের উপর নির্ভর করে।
  • চাকলা রোশনাবাদের কৃষক না থাকলে রাজপরিবার উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের মতো প্রাসাদোপম স্থাপত্য নির্মাণ তো দূরের কথা, রাজ্য পরিচালনাও সম্ভব হতো না।
  • সুতরাং বাঙালিরা শুধু প্রজা ছিলেন না, বরং রাজ্যের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ছিলেন।

সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন

ত্রিপুরার ইতিহাস কোনো একক জনগোষ্ঠীর নয়। রাজপরিবার, পাহাড়ি উপজাতি সমাজ, এবং সমতল বাঙালি কৃষক— সকলে মিলে ত্রিপুরার ইতিহাস গড়েছেন।

কিন্তু রাজকোষ, রাজপ্রাসাদ ও রাজপরিবারের ঐশ্বর্যের কথা তুললে অবশ্যই বলতে হবে— সমতল অঞ্চলের বাঙালি প্রজাদের অবদানই ছিল মুখ্য।

আজ আমাদের প্রয়োজন—

  • হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করা
  • ইতিহাসের সত্যকে স্বীকার করা
  • সমতল ও পার্বত্য জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত উদ্যোগে ত্রিপুরাকে সমৃদ্ধ প্রদেশে পরিণত করা।

Share this content:

ত্রিপুরা রাজ্যের বাঙালি প্রজাদের অবদান ও উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মাণ ব্যয়ের প্রকৃত ইতিহাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to top