ত্রিপুরার ইতিহাস: কেন বাঙালিকে বাংলাদেশি বলা ভুল — উপজাতি ও বাঙালির প্রকৃত সম্পর্ক জানুন
উপজাতি বাঙালিকে “বাংলাদেশি” বলে অভিহিত করে — কিন্তু ইতিহাস জানলে বোঝা যায়, আমরা সবাই একই মাটির সন্তা
ভূমিকা
আজকের ত্রিপুরায় এক অদ্ভুত বিভাজন লক্ষ্য করা যায় — উপজাতি ও বাঙালির মধ্যে অদৃশ্য এক দেয়াল। কিছু মহল থেকে প্রায়ই শোনা যায়, “বাঙালিরা বাংলাদেশি”, যেন তারা এই মাটির নয়। কিন্তু ইতিহাসের গভীরে তাকালে দেখা যায়, এই বক্তব্য কেবল মিথ্যা নয়, অত্যন্ত অবিচারও বটে। ত্রিপুরার মাটি, নদী, পাহাড়, বন—সবই সাক্ষী যে, এই রাজ্যে যারা বাস করে, তারা সবাই বহু প্রজন্ম ধরে এই ভূমির সন্তান।
ত্রিপুরার ইতিহাস কোনো একদিনে গড়ে ওঠেনি; এটি হাজার বছরের বিবর্তনের ফল। এখানে রিয়াং, ব্রু, চাকমা, মগ, বাঙালি — সবাই তাদের নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অবদান নিয়ে একত্রে একটি সভ্য সমাজ গড়ে তুলেছে। কিন্তু রাজনীতি, ভুল সিদ্ধান্ত, এবং সীমান্তের রেখা এই ঐক্যকে বিভাজনের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
️ প্রাচীন ত্রিপুরা ও মানুষের আগমন
ত্রিপুরার ইতিহাসের শিকড় গভীর ও প্রাচীন। ইতিহাসবিদদের মতে, ত্রিপুরার প্রাচীন অধিবাসীরা মূলত তিব্বত-মায়ানমার অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বংশধর। রিয়াং (ব্রু), চাকমা, মগ, এবং অন্যান্য উপজাতি জনগোষ্ঠী হাজার হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে আসে। তারা মূলত শিকার ও স্থানান্তরিত কৃষির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত।
অন্যদিকে, সমতলভূমিতে বসতি স্থাপন করে বাঙালিরা — যারা এসেছে বঙ্গভূমি থেকে, অর্থাৎ আজকের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কিছু অংশ থেকে। সেই সময়ে কোনো “বাংলাদেশ” নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্বই ছিল না। বরং তখন সমগ্র অঞ্চলই ভারতীয় সভ্যতার অংশ হিসেবে পরিচিত ছিল — একই সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক মানবসমাজ।
অর্থাৎ, তখনকার দিনে সবাই ছিল এক আকাশের নিচে, একই মাটির সন্তান। আজ যে জাতিগত বিভাজন দেখা যায়, তা সম্পূর্ণ আধুনিক রাজনীতির সৃষ্টি, ইতিহাসের নয়।
রাজপরিবার ও সমতলভূমির মানুষের অবদান
ত্রিপুরার রাজপরিবার ইতিহাসে বিশেষ স্থান অধিকার করে। মণিক্য রাজবংশ শত শত বছর ধরে এই রাজ্যের শাসন চালিয়েছে। কিন্তু রাজ্যের অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর ভিত তৈরি করেছিল সমতলভূমির বাঙালি কৃষক ও কারিগররা।
সমতলভূমির বাঙালিরা রাজ্যের কর, খাজনা, কৃষি উৎপাদন ও বাণিজ্যের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল। তারা জমি চাষ করত, রাজ্যের আয় বৃদ্ধি করত, মন্দির ও প্রশাসনিক স্থাপনা নির্মাণে অবদান রাখত।
উপজাতি সমাজও তাদের নিজস্ব পরিসরে সহযোগিতা করেছিল, কিন্তু বৃহত্তর অর্থনৈতিক কাঠামোর ভার মূলত বাঙালিদের কাঁধেই ছিল। রাজপরিবারও জানত — রাজ্যের সমৃদ্ধি নির্ভর করে সমতলভূমির পরিশ্রমী মানুষের ওপর।
ইতিহাসে দেখা যায়, উপজাতিরা অনেক সময় বিদ্রোহ করেছে — কখনও কর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, কখনও জমির অধিকার নিয়ে। কিন্তু বাঙালিরা রাজপরিবারের প্রতি অনুগত ছিল। তারা কখনো রাজদ্রোহ করেনি, বরং রাজাকে রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছে।
⚖️ রাজপরিবারের ভুল ও ঐতিহাসিক বিপর্যয়
ত্রিপুরার ইতিহাসে রাজপরিবার যেমন অবদান রেখেছে, তেমনি কিছু সিদ্ধান্ত ছিল মারাত্মক ভুল — যার ফল আজও সাধারণ মানুষ ভোগ করছে।
১. মুঘল চুক্তি ও সমতলভূমি হারানো
মণিক্য রাজারা মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যার ফলে ত্রিপুরা হারায় বিশাল পরিমাণ উর্বর জমি — কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর প্রভৃতি অঞ্চল ত্রিপুরার নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে যায়। এই অঞ্চলে ছিল বাঙালিদের প্রধান কৃষি ও বাণিজ্যকেন্দ্র।
২. ব্রিটিশ প্রোটেক্টরেট ও পাহাড়ি অঞ্চল হারানো
১৮০০ শতকের মাঝামাঝি রাজপরিবার ত্রিপুরাকে ব্রিটিশ প্রোটেক্টরেট ঘোষণা করতে সম্মত হয়। এর ফলে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, সাজেকসহ বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল রাজ্যের আওতা থেকে বাদ পড়ে যায়। উপজাতিদের বাসভূমি দুটি শক্তির মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায় — একাংশ চলে যায় চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে।
৩. ১৯৪৭–৪৯: বিভাজনের সময় রাজনৈতিক দুর্বলতা
সবচেয়ে বড় ভুলটি ঘটে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়। ত্রিপুরা রাজপরিবার তখন স্বাধীন ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক কূটচালে তারা ভারত সংযুক্তির সিদ্ধান্তে বিলম্ব করে। ফলে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী সমতলভূমির অনেক অঞ্চল।
এই রাজনৈতিক ব্যর্থতা বাঙালি জনগোষ্ঠীকে এক অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলে দেয়।
️ বিভাজন ও তার গভীর প্রভাব
দেশভাগের সময় রাজপরিবারের নীরবতা ও দূরদর্শিতার অভাব ত্রিপুরার সামাজিক গঠনকে ভেঙে দেয়। যেদিন বিভাজন কার্যকর হলো, অনেক ত্রিপুরাবাসী ঘুমাতে গেলেন ত্রিপুরার নাগরিক হিসেবে, কিন্তু পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলেন — তারা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী!
সীমান্তরেখা টেনে দেওয়া হলো ব্রিটিশ কাগজে, কিন্তু তা ছিঁড়ে ফেলল হাজার বছরের পারিবারিক সম্পর্ক, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বন্ধন।
ত্রিপুরার সমতলভূমির বাঙালিরা তখন বুঝতে পারল, তাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মের ঘরবাড়ি, জমিজমা, নদী—সব এখন অন্য দেশের অংশ। কেউ কেউ চলে এল ভারতের ত্রিপুরায়, আবার কেউ রয়ে গেল বাংলাদেশে। এই বিভাজনের শিকার হলো সাধারণ মানুষ — রাজপরিবার নয়।
একই মাটির সন্তান — রিয়াং, চাকমা, মগ, বাঙালি
ত্রিপুরা আজ বহু জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত আবাসভূমি। রিয়াং, চাকমা, মগ, লুসাই, হালাম, এবং বাঙালি — সবাই এই রাজ্যের ইতিহাসে অবদান রেখেছে।
- রিয়াং ও অন্যান্য উপজাতি প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে ভূমিকা রেখেছে,
- বাঙালিরা কৃষি ও শিক্ষায় রাজ্যকে এগিয়ে নিয়েছে,
- মগ ও চাকমা সম্প্রদায় বাণিজ্য, কাঠ ও হস্তশিল্পে বিশেষ অবদান রেখেছে।
তাহলে প্রশ্ন আসে — কে “বাইরের”? যদি সবাই এই ভূমিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করে, তবে “বাংলাদেশি” তকমা দেওয়া কি ন্যায্য?
“বাংলাদেশ” নামটি তো এসেছে ১৯৭১ সালে — মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে। অথচ বাঙালিরা ত্রিপুরায় এসেছে শত শত বছর আগে, রাজপরিবারের আমন্ত্রণে, কৃষি উন্নয়নের জন্য। সুতরাং তাদের “বাংলাদেশি” বলা ইতিহাসের পরিপন্থী, এমনকি অপমানজনকও।
সত্য ইতিহাস — রাজপরিবারের ভুল, মানুষের নয়
ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যায় — ত্রিপুরার বিভাজন ও আজকের সামাজিক দ্বন্দ্বের জন্য সাধারণ মানুষ দায়ী নয়। ভুল হয়েছে রাজপরিবারের দিক থেকে।
তারা যদি দেশভাগের সময় আরও দূরদর্শিতা দেখাত, যদি মুঘল ও ব্রিটিশদের সঙ্গে কূটনীতি আরও দৃঢ়ভাবে করত, তবে আজ ত্রিপুরা হতো একটি বৃহৎ, ঐক্যবদ্ধ রাজ্য — যেখানে বাঙালি ও উপজাতি একসঙ্গে বসবাস করত, কোনো জাতিগত বিভাজন ছাড়াই।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রাজনীতির স্বার্থে মানুষকে আলাদা করা হয়েছে, সীমান্ত টানা হয়েছে, এবং জাতিগত পরিচয়কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট — ঐক্যের ডাক
আজও কিছু রাজনৈতিক শক্তি উপজাতি-বাঙালি বিভাজন টিকিয়ে রাখতে চায়, নিজেদের স্বার্থে। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে — বিভাজন নয়, ঐক্যই ত্রিপুরার শক্তি।
শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি — প্রতিটি ক্ষেত্রে উপজাতি ও বাঙালির মিলিত প্রচেষ্টা ত্রিপুরাকে এগিয়ে নিতে পারে। পাহাড় ও সমতলের মিলনেই গড়ে উঠতে পারে এক নতুন, সমৃদ্ধ ত্রিপুরা।
উপসংহার — “আমরা সবাই এই মাটির সন্তান”
ইতিহাস জানলে বোঝা যায়, উপজাতি ও বাঙালি কারও আগমন বাইরের নয় — সবাই এই ভূমির অংশ, এই আকাশের সন্তান।
ত্রিপুরার বিভাজনের ইতিহাস রাজপরিবারের ভুল সিদ্ধান্তের ফল, সাধারণ মানুষের নয়।
সুতরাং এখন সময় এসেছে সত্যিটা জানার, অহংকারের সঙ্গে বলার —
“আমরা কেউ বাংলাদেশি নই, কেউ বিদেশি নই।
আমরা সবাই ত্রিপুরার সন্তান — একই মাটির, একই আকাশের।”
ত্রিপুরার প্রকৃত ঐতিহ্য জাতিগত বিভাজনে নয়, বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সংস্কৃতির মেলবন্ধন ও সহাবস্থানে নিহিত।
সত্য জানো। ইতিহাস জানো।
অহংকারের সঙ্গে বলো —
আমরা সবাই এই মাটির সন্তান।
ত্রিপুরার ইতিহাস: কেন বাঙালিকে বাংলাদেশি বলা ভুল — উপজাতি ও বাঙালির প্রকৃত সম্পর্ক জানুন
Share this content: