ত্রিপুরায় বাঙালি জাতির বসবাসের ইতিহাস
ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক রাজ্য, যার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহুবিধ ও বহুজাতিক। এই রাজ্যের আদি বাসিন্দা হলেন মূলত ত্রিপুরী, রিয়াং, চাকমা, মোগ, হালাম, কুকি প্রভৃতি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। তবে বাঙালি জাতিও বহু শতাব্দী ধরে এখানে বসবাস করছে।
প্রাচীন যুগে বাঙালিদের আগমন
ত্রিপুরা ও সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গদেশের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল। কামরূপ, কোকবরকভাষী রাজ্য ও ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে বাংলার সংযোগ ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। ১৪-১৫ শতক থেকেই কিছু বাঙালি ব্যবসায়ী ও হিন্দু পুরোহিত ত্রিপুরায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন।
ত্রিপুরা রাজপরিবার ও বাংলার সম্পর্ক
ত্রিপুরার রাজারা (মণিক্য বংশ) বাংলার সুলতান ও পরে মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতেন। এই সময় থেকেই বাংলার কবি, পুরোহিত, কর্মচারী এবং সাধারণ কৃষকরা ত্রিপুরায় বসতি স্থাপন করতে থাকেন। বিশেষত ১৫ শতক থেকে বাঙালিরা রাজদরবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
নবাবি ও ঔপনিবেশিক যুগে বাঙালিদের বসতি
১৭শ ও ১৮শ শতকে যখন বাংলায় মুঘল এবং পরবর্তীকালে নবাবি শাসন চলছিল, তখন ত্রিপুরার রাজ্য বাংলার অন্তর্গত না হলেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় ছিল। অনেক বাঙালি কর্মকর্তা, কেরানি, ব্যবসায়ী ও কৃষিজীবী জনগণ তখন ত্রিপুরায় চলে আসেন।
ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ১৮শ শতকের শেষভাগ ও ১৯শ শতক জুড়ে পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালি কৃষক উর্বর সমতলভূমিতে বসতি গড়ে তোলে।
দেশভাগ ও উদ্বাস্তু বাঙালির আগমন
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে বিপুল সংখ্যক হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তু ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লক্ষাধিক মানুষ ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। এই অভিবাসনের ফলে ত্রিপুরায় বাঙালি জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
বর্তমান পরিস্থিতি
আজকের দিনে ত্রিপুরায় বাঙালি জাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৯৫১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ত্রিপুরায় বাঙালি জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩৭ শতাংশ। বর্তমানে তা ৬৫ শতাংশেরও বেশি। অর্থাৎ, ত্রিপুরার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে বাঙালিরা প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
ত্রিপুরায় ত্রিপুরীদের বসবাসের ইতিহাস
ত্রিপুরা রাজ্যের আদি অধিবাসী হলেন ত্রিপুরী জনগোষ্ঠী (যাদের স্থানীয় ভাষা কোকবরক)। তাদের ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং বহু শতাব্দী ধরে তারা এই ভুমিতে বসবাস করে আসছেন।
আদি উত্স
ইতিহাসবিদদের মতে, ত্রিপুরীরা মূলত তিব্বত-বর্মা ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তাদের পূর্বপুরুষরা বহু হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (চীন, মিয়ানমার অঞ্চল) থেকে ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে সরে আসেন। ধারণা করা হয় প্রায় দুই হাজার বছর আগে তারা উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে এসে বসতি গড়ে তোলে।
ত্রিপুরা রাজ্যের প্রতিষ্ঠা
ত্রিপুরীদের ইতিহাস অনুযায়ী, মণিক্য রাজবংশ (Tripura Manikya Dynasty) প্রায় খ্রিস্টীয় নবম শতক (৯ম শতাব্দী) থেকে শাসন শুরু করে। এই সময় থেকেই ত্রিপুরীরা সংগঠিত রাজ্য গড়ে তোলে এবং দীর্ঘ প্রায় ১৩ শতাব্দী ধরে (১৯৪৯ সাল পর্যন্ত) ত্রিপুরা রাজ্যের শাসনক্ষমতায় ছিল।
প্রাচীন সাহিত্যিক উল্লেখ
বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যে (যেমন রাজমালা, মহাভারতের কিছু অংশে) ত্রিপুরার উল্লেখ পাওয়া যায়। “রাজমালা”, যা ত্রিপুরার রাজাদের বংশবৃত্তান্ত নিয়ে রচিত, সেখানে বলা হয়েছে ত্রিপুরা রাজ্য বহু হাজার বছর আগে থেকে বিদ্যমান ছিল। যদিও ইতিহাসবিদরা প্রমাণ হিসেবে খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতাব্দীকেই বেশি গ্রহণ করেন।
ত্রিপুরীদের উৎপত্তি ও বসবাস
ত্রিপুরীরা সত্যিই তিব্বত-বর্মা ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তাদের পূর্বপুরুষরা হাজার হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (চীন–মিয়ানমার অঞ্চল) থেকে এই অঞ্চলে এসেছিলেন।
Share this content: