Breaking
25 Sep 2025, Thu

ত্রিপুরায় বাঙালিদের বসবাস: ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট

ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রাচীন রাজ্য, যার ইতিহাস রাজপরিবার, সংস্কৃতি ও জনজাতির বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। বাঙালিদের বসবাস ত্রিপুরায় কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই শুরু হলেও এর প্রধান ধারা গড়ে ওঠে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে।

স্বাধীনতার আগে ত্রিপুরা রাজ্যের অঞ্চল

  1. আজকের ত্রিপুরা রাজ্য
    পুরো বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যই স্বাধীনতার আগে মণিক্য রাজাদের অধীনস্থ দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজধানী ছিল আগরতলা।
  2. বাংলাদেশের কিছু অংশ
    ইতিহাস অনুযায়ী, ত্রিপুরা রাজ্যের অধীন অনেক এলাকা পরবর্তীতে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। যেমন—

    • কুমিল্লা জেলার বড় অংশ (বিশেষত বর্তমান কুমিল্লা সদর, লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম অঞ্চল)
    • নোয়াখালী জেলার কিছু অংশ
    • সিলেটের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল
    • চট্টগ্রাম জেলার পার্বত্য অঞ্চল

    এসব এলাকা একসময় মণিক্য রাজাদের অধীন ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে মুঘল ও পরে ব্রিটিশ শাসনকর্তাদের হাতে চলে যায়।

  3. রাজ্যের কেন্দ্র ও উপনিবেশ
    আগরতলা, উদয়পুর (প্রাচীন রাজধানী), আমরপুর, হর, ধলাই, সোনামুড়া প্রভৃতি এলাকা ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের মূল কেন্দ্র।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

  • ১৮শ শতাব্দীতে মণিক্য রাজারা বারবার মুঘল ও পরে ব্রিটিশদের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন। এর ফলে বাংলার বহু এলাকা (বিশেষ করে কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল) ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে ব্রিটিশ বাংলার সঙ্গে যুক্ত হয়।
  • স্বাধীনতার আগে ত্রিপুরা ছিল ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত একটি দেশীয় রাজ্য (Princely State), তবে অভ্যন্তরীণ শাসনাধিকার মণিক্য রাজাদের হাতেই ছিল।

১. প্রাচীন সংযোগ

ত্রিপুরার রাজাদের সঙ্গে বাংলার (বিশেষ করে সমতট ও গৌড় রাজ্যের) রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল বহু পুরনো। চন্দ্রপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বহু বাঙালি কৃষক, কারিগর ও ব্রাহ্মণ পরিবার ত্রিপুরায় বসতি স্থাপন করেছিল। বিশেষত, রাজাদের দরবারে পুরোহিত, কবি ও কারিগরের চাহিদা বাড়ার ফলে ধীরে ধীরে বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

২. মুঘল ও মণিক্য রাজাদের যুগ

১৬শ ও ১৭শ শতকে মুঘলদের সঙ্গে মণিক্য রাজাদের সংঘর্ষ ও সন্ধির কারণে বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ত্রিপুরায় চলে আসে। সেই সময়ে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের অনেকেই কৃষিকাজ ও প্রশাসনিক কাজে যুক্ত হতে এসে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে।

৩. ঔপনিবেশিক আমল

১৮শ শতকের শেষভাগ থেকে ১৯শ শতকে ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠার পর, ত্রিপুরা রাজ্যের রাজনৈতিক গুরুত্ব নতুনভাবে বৃদ্ধি পায়। কুমিল্লা, সিলেট ও নোয়াখালী অঞ্চল ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত হলেও ত্রিপুরা তখনও দেশীয় রাজ্য ছিল। তবুও প্রশাসনিক, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষা বিস্তারের কারণে প্রচুর বাঙালি ত্রিপুরায় এসে বসবাস শুরু করে। আগরতলা শহর তখন ধীরে ধীরে বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

৪. দেশভাগ ও উদ্বাস্তু প্রবাহ

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ববঙ্গ (পরে পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে ব্যাপক হারে হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তু ত্রিপুরায় প্রবেশ করে। বিশেষ করে সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ঢাকা অঞ্চল থেকে লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ত্রিপুরায় এসে আশ্রয় নেয়। এসময় ত্রিপুরার জনসংখ্যার গঠন একেবারেই পাল্টে যায় এবং বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

৫. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রায় ১০ লক্ষ শরণার্থী ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। যুদ্ধ শেষে অনেকেই ফিরে গেলেও, উল্লেখযোগ্য অংশ এখানেই থেকে যায়। এর ফলে ত্রিপুরার সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে বাঙালিদের প্রভাব আরও গভীর হয়।

৬. বর্তমান চিত্র

আজকের দিনে ত্রিপুরার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বাঙালি। বাংলা ভাষা রাজ্যের প্রধান ভাষা, যদিও ককবরক ও অন্যান্য জনজাতির ভাষারও গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। শিক্ষা, সাহিত্য, সংগীত, থিয়েটার ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বাঙালির অবদান ত্রিপুরার পরিচিতি গড়ে তুলেছে।

Share this content:

Also Read  ত্রিপুরা রাজ্যের বাঙালি প্রজাদের অবদান ও উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মাণ ব্যয়ের প্রকৃত ইতিহাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *