গ্রুপ ডি কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় বেতন কমিশনের অধীনে ন্যায্য বেতন ম্যাট্রিক্সের দাবি
ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির কাঠামো বহু বছর ধরে একাধিক বেতন কমিশনের মাধ্যমে গঠিত ও সংস্কার করা হয়েছে। বেতন কমিশনের মূল উদ্দেশ্য হল দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রাস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং সরকারি কর্মচারীদের কর্মদায়িত্ব বিবেচনা করে একটি ন্যায্য বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে এক শ্রেণির কর্মী—গ্রুপ ডি কর্মচারী—দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন যে, বেতন কাঠামো ও বেতন ম্যাট্রিক্সে তাঁদের প্রকৃত চাহিদা ও প্রাপ্যতা পূর্ণমাত্রায় প্রতিফলিত হয়নি।
গ্রুপ ডি কর্মচারী কারা?
গ্রুপ ডি বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা হলেন সেইসব সরকারি কর্মী যারা মূলত সহায়ক ও শ্রমনির্ভর কাজ করেন। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত—
দপ্তরি ও পিওন
মালির কাজ
সাফাই কর্মী
লোডিং ও আনলোডিং কর্মী
হেল্পার, ক্যান্টিন স্টাফ ইত্যাদি
এদের কাজ শারীরিক পরিশ্রমনির্ভর এবং অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন পরিবেশে সম্পাদিত হয়। তবুও, দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের বেতন অন্যান্য গ্রুপ (A, B, C) কর্মচারীদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
বেতন ম্যাট্রিক্সের প্রেক্ষাপট
৭ম কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন (৭ম সিপিসি) চালু হওয়ার পর বেতন নির্ধারণে Pay Matrix নামের একটি সিস্টেম প্রবর্তিত হয়। এর মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ ও স্তরের কর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট Pay Level ধার্য করা হয়, এবং সেই অনুযায়ী বেসিক বেতন ও ইনক্রিমেন্ট নির্ধারণ হয়।
গ্রুপ ডি কর্মচারীদের জন্য সাধারণত Level 1 বা তার কাছাকাছি পে লেভেল নির্ধারণ করা হয়, যা বর্তমান সময়ে (২০২5 সালের হিসাবে) প্রায় ₹18,000 বেসিক বেতন থেকে শুরু হয়। কিন্তু সমস্যাটি হল—
1. এই বেতন বর্তমান জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
2. মুদ্রাস্ফীতির হারে বেতন বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়।
3. অন্যান্য গ্রুপের তুলনায় বেতন ফারাক অনেক বেশি।
ন্যায্য বেতনের দাবির পেছনের কারণ
গ্রুপ ডি কর্মচারীরা যুক্তি দেন, তাঁদের কাজ প্রায়ই অস্বাস্থ্যকর ও বিপদজনক পরিবেশে হয়—যেমন সাফাই কর্মী, হাসপাতালের সহকারী, রেলওয়ে পোর্টার ইত্যাদি। এছাড়াও, শারীরিক পরিশ্রম ও দীর্ঘ কর্মঘণ্টার কারণে তাঁদের পেশাগত স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেশি। অথচ—
চিকিৎসা সুবিধা অনেক ক্ষেত্রে সীমিত
পদোন্নতির সুযোগ প্রায় নেই
বোনাস বা বিশেষ ভাতা অন্যান্য গ্রুপের তুলনায় কম
এই প্রেক্ষাপটে, ন্যায্য বেতন ম্যাট্রিক্স বলতে বোঝানো হচ্ছে এমন একটি কাঠামো যেখানে গ্রুপ ডি কর্মচারীদের বেসিক বেতন ও ইনক্রিমেন্ট পর্যাপ্ত হবে, জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্য থাকবে, এবং কাজের ঝুঁকি ও কষ্টের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে।
প্রধান দাবিগুলি
গ্রুপ ডি কর্মচারীদের সংগঠন ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলির দাবি সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়ে কেন্দ্রীভূত—
1. বেসিক বেতন বৃদ্ধি — পে লেভেল 1-এর প্রারম্ভিক বেতন ₹18,000 থেকে বাড়িয়ে অন্তত ₹26,000 করা।
2. ঝুঁকি ভাতা (Risk Allowance) — শারীরিকভাবে বিপদজনক বা স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য অতিরিক্ত ভাতা।
3. ডিএ (Dearness Allowance) কাঠামো পুনর্বিবেচনা — মুদ্রাস্ফীতির সাথে সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি।
4. ইনক্রিমেন্টের হার বাড়ানো — বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট 3% থেকে 5% করা।
5. প্রমোশনের সুযোগ বৃদ্ধি — গ্রুপ ডি থেকে গ্রুপ সি-তে পদোন্নতির সুস্পষ্ট নীতি।
6. চিকিৎসা ও পেনশন সুবিধার উন্নতি — সাশ্রয়ী ও কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা, এবং অবসরোত্তর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
অষ্টম বেতন কমিশন নিয়ে প্রত্যাশা
২০২6 সালের মধ্যে অষ্টম কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রুপ ডি কর্মচারীরা আশা করছেন, এই কমিশন তাঁদের বহু বছরের সমস্যার সমাধান আনবে। তাঁদের মতে—
নতুন পে ম্যাট্রিক্সে লেভেল 1 ও লেভেল 2-এর মধ্যে ব্যবধান কমাতে হবে।
বেসিক বেতন এমন হতে হবে যা মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব কাটিয়ে জীবনযাত্রা নির্বিঘ্ন রাখবে।
গ্রামীণ ও শহুরে এলাকার জীবনযাত্রার ব্যয়ের পার্থক্যও বিবেচনা করা উচিত।
সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা
সরকারি কর্মচারীদের বেতন নির্ধারণ কেবল অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্বও। গ্রুপ ডি কর্মচারীরা দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর ভিত্তি—তাঁদের অবহেলা করা মানে সেই ভিত্তিকে দুর্বল করা। প্রশাসনের উচিত—
তাঁদের কাজের গুরুত্ব স্বীকার করা
বেতন নির্ধারণে সমতা ও ন্যায়বিচার বজায় রাখা
আর্থিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা
আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত
অনেক দেশে নিম্নস্তরের সরকারি কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম মজুরি আইন শক্তিশালীভাবে কার্যকর। যেমন—
যুক্তরাজ্যে “Living Wage” ধারণা কার্যকর, যা মুদ্রাস্ফীতির সাথে নিয়মিত সমন্বয় হয়।
অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি কর্মীদের জন্য Fair Work Commission নিয়মিত বেতন কাঠামো হালনাগাদ করে।
ভারতেও এমন নীতি গ্রহণ করলে গ্রুপ ডি কর্মচারীদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান উন্নত হবে।
Share this content: